বাংলা শিশু সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখক হলেন সুকুমার রায়। আমরা সবাই তাঁর মজার কবিতা পড়ে বড় হয়েছি। এই আর্টিকেলে এই সনামধণ্য সাহিত্যিক, সুকুমার রায় রচনাবলী ও তাঁর জীবনী নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করবো।
সুকুমার রায় রচনাবলী :
- আবোল তাবোল
- পাগলা দাশু
- অবাক জলপান
- হ য ব র ল
- লক্ষ্মণের শক্তিশেল
- বহুরুপী
- ঝালাপালা ও অনান্য নাটক
- চলচ্চিত্তচঞ্চরী
- খাই খাই
- শব্দ কল্প দ্রুম
শিশু সাহিত্যিক সুকুমার রায়
📌 জন্ম:
সুকুমার রায় জন্ম গ্রহণ করেছিলেন ১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দের ৩০শে অক্টোবর কলকাতার বিখ্যাত রায়চৌধুরী পরিবারে।
📌 পিতা ও মাতা :
তাঁর পিতা ছিলেন উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী যিনি একজন শিশু সাহিত্যিক, সংগীতজ্ঞ, চিত্রশিল্পী ও যন্ত্রকুশলী।
📌 জীবন পুঞ্জি :
জন্ম | অধুনা বাংলাদেশের ময়মনসিংহ শহরে,৩০ অক্টোবর ১৮৮৭ |
প্রয়াণ | ১০ সেপ্টেম্বর ১৯২৩ (৩৫ বছর বয়সে ) ১০০ নং গড়পার রোড |
পিতা | উপেন্দ্রকিশোর রায় |
মাতা | বিধুমুখী দেবী |
শিক্ষা | B.Sc(রসায়ন) (প্রেসিডেন্সি কলেজ) |
ছদ্মনাম | উহ্যনাম পণ্ডিত |
পত্নী | সুপ্রভা দেবী |
সন্তান | সত্যজিৎ রায় |
রচনাবলী | আবোল তাবোল, পাগলা দাশু, অবাক জলপান, হ য ব র ল,লক্ষ্মণের শক্তিশেল,বহুরুপী, ঝালাপালা ও অনান্য নাটক,চলচ্চিত্তচঞ্চরী, খাই খাই,শব্দ কল্প দ্রুম |
📌 বাল্যকাল :
পিতার কাছ থেকেই উত্তরাধিকার সূত্রে সাহিত্যের প্রতিভা লাভ করেছিলেন বালক সুকুমার। তিনি অল্প বয়স থেকেই মুখে মুখে ছড়া তৈরি করতে পারতেন।
ছবি আঁকারও হাতেখড়ি হয়েছিল বাবা উপেন্দ্রকিশোরের কাছে। আঁকার সঙ্গে ফটোগ্রাফির চর্চাও শুরু করেছিলেন ছেলেবেলা থেকেই।
📌 শিক্ষাজীবন :
সুকুমার রায়ের পড়াশুনা শুরু হয় সিটি স্কুলে। রসায়নে অনার্স সহ তিনি বি.এস.সি পাশ করেন প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে।
এরপর ফটোগ্রাফি আর মুদ্রণ শিল্পে উচ্চতর শিক্ষালাভের জন্য গুরু প্রসন্ন ঘোষ স্কলারশিপ নিয়ে ১৯১১ খ্রিঃ বিলেত যাত্রা করেন।
তিনি স্কুলে পাঠরত অবস্থাতেই ছোটদের হাসির নাটক লেখা ও অভিনয়ের শুরু করেন। বন্ধুদের নিয়ে গড়ে তোলেন হাসির ও মজার ননসেন্স ক্লাব। ক্লাবের মুখপত্রের মজার নাম ছিল সাড়ে- বত্রিশ ভাজা।
তিনি বিলেত যাবার আগে শান্তিনিকেতনে গিয়েছিলেন। সেখানে রবীন্দ্রনাথ ও অবনীন্দ্রনাথের সঙ্গে গোড়ায় গলদ নাটকে অভিনয় করেন।
আরও জানুন : রসায়নের জনক কে ও তাঁর জীবনী
তখন লন্ডনের পেনরোজ পত্রিকার সঙ্গে উপেন্দ্রকিশোরের যোগাযোগ ছিল। বিলাত বাসের সময় এই পত্রিকার সম্পাদক মিঃ গম্বেল-এর তিনি সহযোগিতা পেয়েছিলেন। তাঁরই চিঠি নিয়ে সুকুমার লন্ডনের L.C.C.School of Photo Engraving and
Lithography তে বিশেষ ছাত্ররূপে ভর্তি হন। এই সময় ফটোগ্রাফিক সোসাইটি লাইব্রেরিতে নিয়মিত পড়াশোনাও করতেন।
১৯১২ খ্রিঃ ম্যাঞ্চেস্টারের স্কুল অব টেকনোলজিতে বিশেষ ছাত্ররূপে স্টুডিও ও লেবরেটরির কাজ শিখেছিলেন তিনি।
পড়াশোনার কাজের ফাঁকে সুকুমার রায়, প্রবাসী ভারতীয়দের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। এই সুযোগে লন্ডন প্রবাসী অনেক বিখ্যাত বাঙ্গালীর সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। রবীন্দ্রনাথ তখন গীতাঞ্জলির পান্ডুলিপি নিয়ে লন্ডনে গেলে সুকুমার তাঁকে নানাভাবে সহযোগিতা করেছিলেন।
📌 কর্মজীবন ও অবদান :
এই সময় East and West Society-এর আহ্বানে সুকুমার নিজের লেখা প্রবন্ধ The Spirit of Rabindranath পাঠ করেন। এই প্রবন্ধের সঙ্গে কবির অনেকগুলি কবিতারও অনুবাদ ছিল। পরে প্রবন্ধটি Quest পত্রিকায় ছাপা হয়।
এই সময় লন্ডনে দুবছর ছিলেন সুকুমার রায়। সেখান থেকে নিয়মিত ভাবে শুরু করেন গল্প, কবিতা লেখা ও ছবি আঁকা যা পাঠাতেন বাবার সন্দেশ পত্রিকার জন্য। এই ভাবেই তিনি সন্দেশের পাঠক-পাঠিকাদের কাছে সুনামী হয়ে উঠেছিলেন।
লন্ডনে থাকাকালে সুকুমার রায় রয়েল ফটোগ্রাফিক সোসাইটির সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। তাঁর আগে একমাত্র স্যার যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর এই সম্মান পেয়েছিলেন।
সুকুমার দেশে ফিরে এসে পিতার প্রতিষ্ঠিত U Roy & Sons-এর দায়িত্ব নিলেন। শারীরিক অসুস্থতার জন্য উপেন্দ্রকিশোর আগেই প্রতিষ্ঠানের ভার তুলে দিয়েছিলেন ছেলেদের হাতে।
ইতিমধ্যে সুকুমারের বিয়ে হল। রবীন্দ্রনাথ বন্ধু পুত্রের বিয়েতে শিলাইদহ থেকে এসেছিলেন কলকাতায়। ১৯৯০ খ্রিঃ উপেন্দ্রকিশোরের মৃত্যু হয়। সুকুমার ভাইদের সঙ্গে ব্যবসায় পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত হলেন। এই সময় তাঁর উদ্যোগে গড়ে ওঠে মানডে ক্লাব। এই ক্লাবের সভ্যদের মধ্যে ছিলেন কালিদাস নাগ, অতুলপ্রসাদ সেন, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ অনেকে।
সন্দেশের প্রতিটি সংখ্যাতেই সুকুমার রায় নানা বিষয়ে লিখতেন, ছবি আঁকতেন। শিশু-কিশোরদের উপযোগী বিজ্ঞান-সাহিত্য রচনায়ও তিনি পারদর্শী ছিলেন।
সুকুমারের গল্প ও কবিতায় থাকতো উচ্ছল কৌতুক রসের সঙ্গে সূক্ষ্ম সমাজ চেতনার সংমিশ্রণ। তিনি তাঁর লেখা ও ছবির মাধ্যমে বাংলা দেশের শিশুচিত্ত জয় করে নিতে সক্ষম হয়েছিলেন।
সন্দেশে লেখার গোড়ার দিকে সুকুমার ছদ্মনাম গ্রহণ করেছিলেন। উহানাম পণ্ডিত ছিল তাঁর ছদ্মনাম। পরে স্বনামেই লেখেন গল্প, কবিতা, নাটক ও প্রবন্ধ। জীবনের শেষ পর্বে অবশ্য কিছু লেখা লিখেছিলেন উহ্যনাম পণ্ডিত নামে ৷
সুকুমারের রচনা কাব্যগ্রন্থ আবোল তাবোল, খাইখাই, প্রবন্ধ—অতীতের ছবি, বর্ণমালাতত্ত্ব, নাটক—অবাক জলপান, ঝালাপালা, লক্ষ্মণের শক্তিশেল, হিংসুটে, ভাবুকসভা, চলচ্চিত্তচঞ্চরি ও শব্দকল্পদ্রুম, গল্পগ্রন্থ—হ-য-ব-র-ল, পাগলা দাশু, বহুরূপী প্রভৃতি।
তাছাড়া ইংরাজি ও বাংলায় তিনি কিছু গুরুগম্ভীর প্রবন্ধও রচনা করেছিলেন। সুকুমার ছিলেন রসিক মনের মানুষ। ফলে তার স্বভাবসুলভ রসের সঙ্গে প্রখর কল্পনা ও অপরূপ ভাষা মিলে তাঁর রচনাগুলিকে করে তুলেছিল পরম উপভোগ্য। লেখাকে অধিকতর স্বাদু করে তুলেছিল তাঁর আঁকা ছবি ।
১৯২১ খ্রিঃ জন্ম হয় সুকুমারের একমাত্র সন্তান সত্যজিতের। এরপরেই তিনি আক্রান্ত হন কালাজ্বরে। দুই বছরেরও বেশি সময় সংগ্রাম করেছেন রোগের সঙ্গে। অসুস্থ অবস্থাতেও অনর্গল লিখেছেন, ছবি এঁকেছেন। এই সময় রবীন্দ্রনাথ এসে তাঁকে গান শোনাতেন, ধর্মকথা শোনাতেন পণ্ডিত ক্ষিতিমোহন সেন।
📌 প্রয়াণ :
শেষ জীবনে কালাজ্বরে আক্রান্ত হয়ে মাত্র ৩৬ বছর বয়সে জীবনের মেয়াদ ফুরিয়ে এসেছিল তাঁর । ১৯২৩ খ্রিঃ ১০ই সেপ্টেম্বর সুকুমার রায় পরলোক গমন করেন এবং এই অল্প সময়ে রেখে যান আমাদের জন্য হাসির শিশু মন বিকাশের স্বর্ণময় সাহিত্য।